৪ আগষ্টের পূর্ব পর্যন্ত জেলার রাজপথের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামীলীগের। বিএনপি-জামাত সহ বিরোধীদল গুলো রাজপথে দাঁড়াতেই পারছিলনা হামলা-মামলার ভয়ে। দলগুলোকে মাঠের বাহিরে দৌড়ের উপর রাখতে আওয়ামীলীগ আর পুলিশের আচরণ ছিল ভয়ানক আগ্রাসী। একের পর এক মিথ্যা মামলায় অনেক নেতাকর্মীর ঠিকানা হয় কারাগার না হয় বাড়ি ছাড়া পালিয়ে বেড়ানো যাযাবর জীবন।
জেলার রাজনৈতিক এমন পরিস্থিতি আওয়ামীলীগের শাসনামলের পুরো সময়েরই চিত্র। কিন্ত হটাৎ পাল্টে যায় রাজার নীতির সব হিসেব-নিকেষ।
৫ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার ঢাকা ঘেরাও চলাকালে এবং গণভবনমুখী ছাত্র-জনতার উত্তাল স্রোতের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পালিয়ে যাওয়া এবং সেই সাথে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের খবরে সারা দেশের মতো মৌলভীবাজারের প্রতিটি সড়ক ও অলিগলিতে নেমে আসে হাজার হাজার উল্লাসিত জনতা।
জেলা জুড়ে শুরু হয় ক্ষুব্ধ জনতার সরকারি স্থাপনা সহ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্টানে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। ভয় আর আতঙ্কে প্রথম সারির শীর্ষ নেতা সহ আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতারা গাঁ-ঢাকা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান।
দল ও সরকারে পতনের পর ভয়ে পুরো জেলার নেতাকর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকেও দেখা যাচ্ছে না প্রকাশ্যে।
খুঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামীলীগের টিকিটে নির্বাচিত মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জিল্লুর রহমান, মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের সংসদ সদস্য সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী মোঃ শাহাবুদ্দিন, মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য সফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিদায়ী সরকারের কৃষি মন্ত্রী উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ সহ চার টি আসনের বিদায়ী সংসদ সদস্যরা ৫ আগষ্ট পটপরিবর্তনের পরপরই চলে যান আত্মগোপনে। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনেও মিলছেনা সংযোগ। এছাড়াও মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান ও নির্বাচিত ৭ জন আওয়ামীলীগ দলীয় কাউন্সিলরও গা-ঢাকা দিয়েছেন। গা-ঢাকা দিয়েছেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল হোসেন ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমানও। এছাড়াও জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে অধিকাংশ উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র সহ সরকার দলীয় বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরাও রয়েছেন আত্মগোপনের তালিকায়।
এ দিকে সরকার পতনের পর মন্ত্রী, এমপি, মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়াও আত্মগোপনে রয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য নেছার আহমেদ, জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য যুক্তরাজ্য প্রবাসী এম এ রহিম (সিআইপি), জেলা যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ রেজাউর রহমান সুমন, সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর সৈয়দ সেলিম হক, জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নওশের আলী খোকন, জেলা যুবলীগের সহসভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রুমেল আহমদ সহ দলটির সবগুলো সহযোগী সংগঠনের নেতারাও এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। প্রকাশ্যে কোথাও নেই তাঁদের তৎপরতা। এসব নেতারা গত ৪ আগষ্ট পর্যন্তই সরব ছিলেন রাজপথে। অনেকে ছাত্র-জনতার উপর হামলায় প্রকাশ্যে সামনে থেকে নেতৃত্বও দিয়েছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ৪ আগষ্ট মৌলভীবাজার শহরে ছাত্র-জনতার উপর আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলার ১০ দিন পর দলটির শীর্ষ নেতা সহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সহ ১৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২ শ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদির। বুধবার (১৪ আগষ্ট) রাতে সদর মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১৫ আগষ্ট) দুপুরে মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মৌলভীবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম নজরুল ইসলাম।
এর আগে চলতি মাসের ৪ আগষ্ট ঢাকা সহ সারা দেশের মতো মৌলভীবাজার শহরেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত কর্মসুচি অনুযায়ী জমায়েতের সিদ্ধান্ত হয়। সেসময় কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামীলীগও আন্দোলন প্রতিরোধে মাঠ দখলের সিদ্ধান্ত নিলে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সেদিন শহরের বেড়িরপার ও চৌমুহনা এ দুটো স্পটে শক্ত অবস্থান নেয় আত্মবিশ্বাসে থাকা আওয়ামীলীগের কয়েকশো নেতাকর্মী। আর সরকারি কলেজ গেট থেকে পৌরসভা গেট পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থী সহ সাধারণ জনতা। দুপুরের পর চৌমুহনা এলাকায় শিক্ষার্থীদের উপর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হামলা চালিয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে মারাত্মক আহত করলে শুরু হয় সংঘর্ষের সূত্রপাত। এর পরই পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট। দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে একটা সময় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ব্যাপক প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। কিছুটা সময়ের জন্য শহরের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রদের হাতে চলে গেলেও সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারীদের হটিয়ে শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।